You are currently viewing মৃত পিতা-মাতার জন্য সন্তানের করণীয়

মৃত পিতা-মাতার জন্য সন্তানের করণীয়

সম্পাদনা: ড. আব্দুল বাসির বিন নওশাদ

পিতা-মাতা মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। তাঁদের স্নেহ, দোয়া ও ত্যাগেই সন্তানের জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়। তাঁদের জীবিত অবস্থায় যেমন সেবা করা অপরিহার্য, তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ইসলাম এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে মৃত পিতা-মাতার হক আদায়ের পথ বাতলে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা অনুযায়ী একজন সন্তান মৃত্যুর পরও কীভাবে তার পিতা-মাতার উপকার করতে পারে, তা আমরা নিচে আলোচনা করছি।

১. প্রাণভরে দোয়া করা সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।

মৃত পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হলো দোয়া। একজন সৎ সন্তানের অন্তর থেকে উচ্চারিত একটিমাত্র “রব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা” তাদের কবরকে উদ্যানের মতো করে দিতে পারে।
আল্লাহ বলেন,
«وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا»
“আর বলো: হে আমার রব! তুমি তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন করে তারা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন” (সূরা ইসরা: ২৪)।
রাসূল (সা.) বলেন,
«إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ: إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ»‏
“একজন মানুষ মারা গেলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম যার দ্বারা উপকার পাওয়া যায়, এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে” (সহীহ মুসলিম: ৪১১৫)।

২. সদকায়ে জারিয়া চলমান সওয়াবের ধারা।

মৃত পিতা-মাতার নামে দান-সদকা করা এমন এক আমল যার সওয়াব মৃত্যুর পরেও তাঁদের কবরকে আলোয় ভরে তোলে।
যেমন: কূপ খনন, মসজিদ বা মাদরাসা নির্মাণ, গরীবকে সাহায্য, ইসলামিক বই বিতরণ, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন, যদি আমি তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করি, তাহলে কি তা তাঁর উপকারে আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ” (সহীহ বুখারি: ১৩৮৮)।

৩. ঋণ ও দায় পরিশোধ আল্লাহর আদালতে মুক্তির কারণ।

কোনো ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যান, তবে তা পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«نَفْسُ المُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حتَّى يُقْضَى عَنْهُ»
“ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত একজন মুমিনের আত্মা আটকে থাকে” (তিরমিজি: ১০৭৮)।

৪. হজ বা ওমরাহ বদলি করা (যদি জীবিত অবস্থায় না করে থাকে)।

মৃত পিতা-মাতা জীবদ্দশায় হজ বা ওমরাহ আদায় না করে থাকলে, সন্তান তাঁদের পক্ষ থেকে তা আদায় করতে পারে।
বর্ণিত হয়েছে, “এক মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা হজের ওয়াদা করেছিলেন কিন্তু তা আদায় করতে পারেননি। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ করব? তিনি বললেন: হ্যাঁ, হজ করো” (সহীহ বুখারি: ১৮৫২)।

৫. সমাজে প্রচলিত মৃত ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিদআত থেকে সতর্ক থাকা।

অনেক সময় পিতা-মাতা বা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর পর আমরা এমন কিছু কাজ করি, যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে ছিল না। বরং পরে তা প্রচলিত হয়েছে এবং ইসলামে এর কোনো দলিল নেই।
উদাহরণসমূহ: উরশ, চল্লিশা, বার্ষিক মজলিস ইত্যাদির আয়োজন করে তা নির্দিষ্ট তারিখে পালন করা।
মিলাদ মাহফিল বা মেজবান করে মৃত ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত খাবার খাওয়ানো।
কবরের পাশে মোমবাতি বা ধূপ জ্বালানো।
কবরের পাশে শিরকপূর্ণ দোয়া করা (যেমন: মৃত ব্যক্তিকে সরাসরি সাহায্যের জন্য ডাকা)।

৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা।

পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তাদের প্রতি সদাচরণের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।
রাসূল (সা.) বলেন,
«إنَّ من أَبَرِّ البِرِّ صِلَةَ الوَلَدِ أهلَ وُدِّ أبيه»
“সন্তান যখন তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে, এটি উত্তম সদ্ব্যবহারের নিদর্শন” (সহীহ মুসলিম: ৬৬৭৯)।

৭. তাঁদের শেখানো দীনী জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া।

যদি পিতা-মাতা আপনাকে কোনো দীনী শিক্ষা দেন, তা আপনি অন্যকে শিখিয়ে দিলে এর সাওয়াব তাঁদের আমলেও পৌঁছাবে।

উপসংহার:

ইসলাম মৃত পিতা-মাতার জন্য সওয়াব পৌঁছানোর অসংখ্য মাধ্যম বাতলে দিয়েছে। এসব আমল শুধু তাঁদের কবরকে আলোকিত করে না, বরং সন্তানের জন্যও আখিরাতে সফলতার সোপান তৈরি করে।
আসুন, আমরা সকলে আমাদের পিতা-মাতার হক আদায়ে সচেষ্ট হই। জীবিত অবস্থায় তাদের প্রতি সদাচরণ এবং মৃত্যুর পর তাদের জন্য দোয়া, সদকা ও নেক আমলের ধারা অব্যাহত রাখি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই সৎ সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদের আমল পিতা-মাতার জন্য রহমতের কারণ হয়- আমিন।
🔶 ব্লগটি শেয়ার করে দিন যেন অন্যরাও উপকৃত হতে পারে।

Leave a Reply